মানিকগঞ্জের বেশির ভাগ নদ-নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে
রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে অবস্থিত জেলা মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর
তীরে অবস্থিত। পদ্মা ও যমুনার মতো দেশের প্রধান দু’টি নদ ছাড়াও এ জেলার বুক
চিড়ে প্রবাহমান ছিল ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী,
ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরীর মতো ৯টি শাখা নদী। জেলায় এসব নদীর
দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। কিন্তু নাব্যতা হারানো এসব নদীর আকার-আয়তন
মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে নদীর গতিসীমা।
মানিকগঞ্জের
মাঝ দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী এখন শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে গেছে। উজানে ভারতের
পানি প্রত্যাহার, ড্রেজিং না করা ও দখলের কারণে প্রায় ছয়টি নদী, ৪২টি
খাল-বিল ও দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। এক সময় যেখানে
বছর জুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও নেই। নৌকার
পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন পানির দেশে পানির
জন্য হাহাকার।
নদ-নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি,
কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু এসবই ক্রমেই হয়ে আসছে সঙ্কুচিত। এ ধারা
অব্যাহত থাকলে নদ-নদীর অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন হবে, তেমনি পাল্টে যাবে
নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এরই মধ্যে কয়েকটি নদীর
অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদী আজ
মৃতপ্রায়। নদীর বুকজুড়ে কেবলই বালু। সেখানে চাষাবাদ করছেন লোকজন। পুরো নদী
পরিণত হয়েছে সবুজ শস্যক্ষেতে।
ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে ধলেশ্বরী আর
কালীগঙ্গা আজ কেবল কাগজে-কলমে রয়েছে, বাস্তবে এ দু’টি নদীর অবস্থা এতটাই
করুণ যে, বুঝার উপায় নেই নদীর বুকে চর না কি চরের বুকে নদী? নদী দু’টিকে
দখল ও দূষণমুক্ত এবং রক্ষা করার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন
মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন ও বেসরকারি উন্নয়ন, গবেষণা
প্রতিষ্ঠান বারসিকসহ সচেতন ও সুশীলসমাজের নেতৃবৃন্দ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড
(পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পাশের জেলা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় যমুনা
থেকে ধলেশ্বরী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে এ নদীটি মানিকগঞ্জের ঘিওর ও
সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিঙ্গাইর হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে।
এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এ নদীর মানিকগঞ্জের ৬০ কিলোমিটারের
তিন-চতুর্থাংশই আছে শুধু নামে। বর্ষা মওসুমে নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে
না বাকি অংশের কিছু জায়গায়। ধলেশ্বরীর শাখা কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই,
মন্দা ও ভুবনেশ্বর নদীর এখন আর অস্তিত্ব নেই। নতুন প্রজন্ম এসব নদীর নাম
বই-পুস্তক আর মুরুব্বিদের মুখে শুনেছে মাত্র, দেখার ভাগ্য হয়নি। ২৬
কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পুরনো ধলেশ্বরী নদী দৌলতপুর উপজেলার মূল যমুনা থেকে
শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় এসে শেষ হয়েছে।
ধলেশ্বরীর আরেকটি
শাখা নদী গাজীখালী একসময় স্রোতস্বিনী থাকলেও বর্তমানে মরা নদীতে পরিণত
হয়েছে। জেলার সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হয়ে গাজীখালী নদী দরগ্রাম,
সাটুরিয়া, গাঙ্গুটিয়া, সুয়াপুর, রোয়াইল, ইউনিয়ন পার হয়ে ঢাকা জেলার সাভারের
বংশী নদীতে মিলেছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী বছরের ৮-৯ মাসই
পানিশূন্য থাকে। সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে নদীটির
বিশাল এলাকা। দখলকৃত জায়গায় কেউ বাড়িঘড় নির্মাণ করেছে, কোথাও আবার
দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, কেউ নিয়মিত চাষাবাদ করে নদীর
অবশিষ্ট চিহ্নটুকু মুছে ফেলছেন।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে
গাজীখালী নদীর উৎসমুখে এক কিলোমিটার এলাকা খনন করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ,
শিডিউল অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় ওই খননে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যমুনার ৪০
কিলোমিটার অংশ মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার পশ্চিম সীমান্তঘেঁষে প্রবাহিত
হয়ে শিবালয় উপজেলায় পাটুরিয়া ঘাটে এসে শেষ হয়েছে। বর্তমানে যমুনার বুকে
বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যা যমুনা পাড়ের
মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনি সঙ্কেত।
দৌলতপুরের কাছে যমুনা থেকে
কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরার কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যন্ত
নদীটির দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে এ নদীর অধিকাংশ স্থানে শুকনো
মওসুমে নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারেই শুকিয়ে গেছে।
হচ্ছে চাষাবাদ। হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বালু ব্যবসায়ীরা। পদ্মার শাখা ইছামতী
হরিরামপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফের পদ্মায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য
প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ১৭ বছর আগে যাত্রাপুরের কাছে বাঁধ
দেয়া হয়। বর্তমানে এ নদীটিও মৃতপ্রায়। কেবল বর্ষা মওসুমে একটা সরু ধারা
প্রবাহিত হয়।
নদী ও খাল-বিলে পানি নেই, জেলেদের ভাগ্যে নেমে এসেছে
সীমাহীন দারিদ্র্য। যাদের মূল পেশাই ছিল নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ
করা, নদীতে পানি না থাকায় পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
সংসারের তাগিদে কেউ কেউ আবার বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ। এ বিষয়ে স্থানীয়
জেলে পরীক্ষিত হালদার বলেন, ‘নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা পড়ছে না।
যেখানে প্রতিদিন কয়েকজন জেলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মাছ ধরত সেখানে এখন
হাজার টাকার মাছও মেলে না।’
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিকের
প্রকল্প সমন্বয়ক বিমল রায় বলেন, ‘এ অঞ্চলের বেশির ভাগ গরিব চাষি আগে এসব
নদী থেকে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে
নেমে গেছে। এতে মারাত্মক সেচ সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকেরা। এর ফলে কৃষি মওসুমে
উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নদ-নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে
স্থবিরতা।’
মানিকগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু বলেন,
‘মানিকগঞ্জে নদীর অনেক প্রভাব ছিল। কিন্তু আজ পানির জন্য হাহাকার চলছে।
নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি সচল ও গতিশীল রাখার পাশাপাশি প্রকৃতি,
পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এড়াতে সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারের
আরো মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।’
মানিকগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান
মাহমুদ জানান, ‘নদী পুনঃখনন না করায় মৎস্য উৎপাদন, নৌকার ব্যবহার ব্যাহত
হচ্ছে। ২০১১-১২ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গাজীখালী, যমুনা ও কালিগঙ্গার বালিরটেক
এলাকায় নদীতে কিছু খননের কাজ হয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট
ফান্ড বরাবর একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।’
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের
ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মামুন উর রশিদ বলেন, ‘মানিকগঞ্জের নদীগুলো মরে
যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্যসহ সর্বত্র এর বিরূপ
প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা
রয়েছে।’উল্লেখ্য, জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের (ইউএনসিইডি)
১৯৯২ সালের সভায় বিশ্ব পরিবেশে পানির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে
বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হচ্ছে।
বিস্তারিত দেখুন মানিকগঞ্জের বেশির ভাগ নদ-নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো