পৃথিবীতে মানুষের পরিচিত অন্যতম ভয়ঙ্কর
প্রাকৃতিক ঘটনা হল তীব্র বজ্রপাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ
বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে তীব্র বজ্রপাতের পরিমাণ। ফলে জীবন ও
সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ হাজার লোক বজ্রপাতে মারা যায় এবং
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার। পরিস্থিতি বিবেচনায়
বিশ্বের অনেক দেশ বজ্রপাতকে অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে
জীবন ও সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছরে
বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ। এ কারণে বাংলাদেশ
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গত ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক
দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে পূর্বের তুলনায়
বর্তমানে অধিকহারে তীব্র বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান
কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির
বিষয়টিকে দায়ী করছে। নাসার একাধিক গবেষণায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত কারণে
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তীব্র বজ্রপাত সংঘটনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পৃথিবীর এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে পূর্বের
তুলনায় বর্তমানে অধিকহারে তীব্র বজ্রপাত সংঘটিত হচ্ছে। অথচ বিজ্ঞানের
আশীর্বাদ পুষ্ট এই সময়ে আবহাওয়ার সর্বাধুনিক পূর্বাভাস প্রযুক্তি যেমন
লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর, বাড়ির ছাদে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড বা এরেস্টার
স্থাপনসহ সর্বোপরি আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম থাকায় বজ্রপাত জনিত ক্ষতির
পরিমাণ অনেক কম হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি কিভাবে অধিক
বজ্রপাত সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে তা বজ্রপাত সৃষ্টির রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে
আছে। বজ্রপাত মূলত এক প্রকার বিদ্যুৎ শক্তি যা মূলত সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত ও
আর্দ্র আবহাওয়ায়। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডল দীর্ঘ শুষ্ক সময় শেষে আদ্র হলে
বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্পপূর্ণ উত্তপ্ত বায়ু দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হতে থাকে।
তখন বজ্র মেঘের সৃষ্টি হয়। বাতাসের প্রভাবে বজ্র মেঘের আপ ড্রাফ ও ডাউন
ড্রাফের মধ্য পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। আর এ
চার্জ যখন ভূপৃষ্ঠের দিকে ডিসচার্জ হয় তখন তীব্র শব্দের সাথে বজ্রপাত
সৃষ্টি হয়। আরো সহজ ভাবে বলা যায় যে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে
সঙ্গে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস উপরে উঠতে থাকে। এভাবে যত বেশি জলীয়বাষ্প
উপরে উঠতে থাকে ততবেশি আকাশে উলম্ব মেঘের তথা বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। আর এই
উলম্ব মেঘ বা বজ্র মেঘ থেকে সৃষ্টি হয় বজ্রপাত। সুতরাং বজ্রপাত সৃষ্টিতে
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সরাসরি বা প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।
তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ঋতুগত অনেক পরিবর্তন সাধিত
হয়েছে। ফলে বর্তমানে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তাপমাত্রার পরিমাণ বিগত
আশি কিংবা নব্বই দশকের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই
বেড়েছে তীব্র বজ্রপাতের পরিমাণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কঙ্গো, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বজ্রপাতের উপর এক গবেষণায় উল্লেখ
করেছেন যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত
১৫ শতাংশ এবং ০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি
বৃদ্ধি পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক
গবেষণায় বলা হয়েছে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের
কারণে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশ হিসেবে
পরিগণিত হয়েছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা
বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশে বর্তমানের
তুলনায় তীব্র বজ্রপাতের পরিমাণ আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে একথা অনেকটা
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই তীব্র বজ্রপাতসহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ
প্রশমিত করতে সব পর্যায় থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি
প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
শেখ মোজাহীদ
সহকারি পরিচালক
পরিবেশ অধিদপ্তর
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়