বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১ ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার।
ছবি: শেখ মোজাহীদ সহকারী পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের
প্রাদুর্ভাব এবং তা অতিমারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের কার্যক্রম
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে লকডাউন ও শাটডাউন।
মনে করা হয় এ কারণে সামগ্রিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার কিছুটা হলেও
উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রকৃতি তার নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও পুনরুদ্ধার করার
অবকাশ পেয়েছে। বৈশ্বিক এ বাস্তবতায় উদযাপিত হচ্ছে এবারের বিশ্ব পরিবেশ
দিবস ২০২১।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কর্তৃক এ
বছরে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে Ecosystem
Restoration এবং স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে Generation Restoration।
বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপনে এবং জনগণের মধ্যেও উক্ত প্রতিপাদ্য ও স্লোগান
সহজভাবে উপস্থাপন করতে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সহজ ভাবানুবাদ করা হয়েছে
যথাক্রমে প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ করি,
প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের মূল
কারণটি হলো পরিবেশের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যে
প্রকৃতিকে হালকা ভাবে গ্রহণ না করা। প্রকৃতি আমাদের যা কিছু দিয়েছে তার
যথার্থ ও টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের যথার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
নিশ্চিত করা। দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং
দায়িত্বশীল আচরণের ভিত্তি আরো প্রশস্ত করার প্রয়াস পায়। তাছাড়া দিবসটি
মানুষের কার্যক্রম কিভাবে পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করে সে সম্পর্কে চিন্তা
করতে ধাক্কা দেয়, সবুজ অর্থনীতি বিকাশে ভোক্তা ও উৎপাদনকারীদের টেকসই
উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ
সংরক্ষণের গুরুত্বের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, সবুজ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে
উৎসাহ প্রদান করে, বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলিকে পরিবেশ
সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সংস্কারে বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে
আগামী প্রজন্মের জন্য সবুজ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পথ দেখায়। তাই পরিবেশ দিবস
উদযাপনের বিষয়টি একটি বৈশ্বিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। যদিও বর্তমানে করোনা
ভাইরাস জনিত কোভিড ১৯ অতিমারির কারণে উদযাপন কার্যক্রম অনেকটাই অনলাইন
ভিত্তিক ও সংক্ষিপ্ত হয়েছে।
এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১
বিশ্বব্যাপী ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রকে
পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন করার জন্য জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি সামনে
এনেছে। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা সকলেই
স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেমের উপর নির্ভর করি। সংক্ষেপে এবং সহজবোধ্য
হিসেবে ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র হল জীবিত উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ ও তার
পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে সম্পর্ক। এর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি এবং
মানবসৃষ্ট ইকোসিস্টেম। মানুষের অগ্রগতি ও উন্নয়নের সমানুপাতিক হারে আমরা
আমাদের প্রিয় পৃথিবীর বিদ্যমান বিভিন্ন ইকোসিস্টেমগুলি ক্ষতিগ্রস্ত এবং
ধ্বংস করে চলেছি। ইকোসিস্টেমের এই যে অপূরণীয় ক্ষতি আমরা করেছি এবং তা যে
খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়েছে তা কিন্তু নয়। খুব দীর্ঘকাল ধরেই চলমান
ইকোসিস্টেমের এই ধ্বংস প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা অত্যন্ত
দ্রুতগতিতে এবং উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মানব সভ্যতা রয়েছে
ধ্বংসের দোরগোড়ায়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির বেশ কিছু তথ্য থেকে আমরা
ইকোসিস্টেম ধ্বংসের এই ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেতে পারি।
প্রতিবছর পৃথিবী থেকে ১০ মিলিয়ন হেক্টর বন হারিয়ে গেছে যা কোরিয়ার
আয়তনের সমান বা কোস্টারিকার আয়তনের দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রতি ০৩ সেকেন্ডে
একটি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ বনভূমি বিশ্ব থেকে হারিয়ে গেছে। গত শতাব্দীতে
পৃথিবীর জলাভূমির অর্ধেক ধ্বংস হয়েছে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রী
সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রবালপ্রাচীরের প্রায় ৫০%
ইতিমধ্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে এবং আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে
বিদ্যমান প্রবাল প্রাচীরের ৯০% পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। বিগত ১৯৭০ সাল থেকে
এ পর্যন্ত মোট স্বাদুপানির ইকোসিস্টেমের ৩০% হারিয়ে গেছে। সার্বিকভাবে
ইকোসিস্টেমের অবক্ষয় জনিত কারণে ইতিমধ্যেই বিশ্বের কমপক্ষে ৩.২ বিলিয়ন
মানুষের জীবনযাত্রার মান নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এভাবে ইকোসিস্টেমের
অবক্ষয় বা ধ্বংস প্রক্রিয়া চলমান থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর মোট
জিডিপির প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার হারাতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের
উৎপাদনশীলতা ১২% পর্যন্ত কমতে পারে। ফলে ২০৪০ সাল নাগাদ খাদ্যের দাম ৩০%
পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাছাড়া ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ ভূমির
অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ইকোসিস্টেমের যে অবক্ষয় সাধিত হবে
তার কারণে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ইকোসিস্টেম বা
বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস এবং এর অবক্ষয়ের ফলে মানুষের সাথে বন্য জীবনের
সম্পর্ক নেতিবাচক উপায়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন অজানা রোগের
প্রাদুর্ভাব ও মহামারী সংগঠিত হবে। বর্তমান কোভিড বিবেচনায় যা শতভাগ সঠিক
মর্মে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ইকোসিস্টেমগুলির
অধিকাংশই ক্ষতির সম্মুখীন। বিশেষ করে ফরেস্ট বায়োম এবং একোয়াটিক
ইকোসিস্টেম সবচেয়ে বেশি অক্ষয়ের সম্মুখীন। প্রাকৃতিক সম্পদের
অনিয়ন্ত্রিত ও মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, বন উজাড় ও কৃষি জমিতে রূপান্তর,
বিভিন্ন কারণে হ্যাবিট্যাট পরিবর্তন, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক
উষ্ণায়ন এবং বিভিন্ন ইনভেসিভ ও একজোটিক প্রজাতি ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশে
বিদ্যমান ইকোসিস্টেমগুলোর ক্রম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। ফরেস্ট ইকোসিস্টেম
ধ্বংসের কারণে বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে বারোটি বন্য প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত
হয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে স্তন্যপায়ী ৪০, পাখি ৪১,
সরীসৃপ ৫৮ এবং উভচর ০৪ টি প্রাণী প্রজাতি আই ইউ সি এন কর্তৃক রেড ডাটা বুকে
তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের
কারণ। অথচ কয়েক দশক পূর্বেও এখানে সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম ছিল। ছিল উদ্ভিদ,
প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের একটি বিস্তৃত ভান্ডার। মূলত ৮০ এর দশকের পর
থেকেই এদেশে ইকোসিস্টেমের অবক্ষয় শুরু হয়। ফলে এর উপর নির্ভরশীল জীবন ও
জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন। এ কারণে
বর্তমানে চলমান উন্নয়নকে টেকসই করতে এবং একই সাথে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য
সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে।
সার্বিক বিবেচনায় এবারের বিশ্ব
পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য এবং স্লোগান বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমের অবক্ষয়
প্রতিরোধ, উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
শেখ মোজাহীদ
সহকারী পরিচালক
পরিবেশ অধিদপ্তর
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়